শনিবার, নভেম্বর ২৩, ২০২৪
Homeঅপরাধঢাবির হলে চোর সন্দেহে মানসিক ভারসাম্যহীন যুবককে পিটিয়ে হত্যা

ঢাবির হলে চোর সন্দেহে মানসিক ভারসাম্যহীন যুবককে পিটিয়ে হত্যা

বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি :

spot_img

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলে ‘চোর সন্দেহে’ মারধরের শিকার হয়ে নিহত তোফাজ্জল হোসেন (৩২) বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার কাঁঠালতলী ইউনিয়নের তালুকের চরদুয়ানী গ্রামের বাসিন্দা। তার বাবার নাম মৃত আবদুর রহমান। তিনি নিজ ইউনিয়নের সাবেক ছাত্রলীগ সভাপতি ছিলেন। মা-বাবাহীন এই যুবক মানসিক ভারসাম্যহীন বলে দাবি করেছেন তার স্বজন, প্রতিবেশী ও রাজনৈতিক নেতা। বুধবার (১৮ সেপ্টেম্বর) দিবাগত রাতে ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ের ওই হলে চোর সন্দেহে তাকে পিটিয়ে হত্যা করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।

জানা গেছে, তোফাজ্জলকে আটকের পর গেস্টরুমে নিয়ে যান শিক্ষার্থীরা। সেখানে তাকে রাত ১০টা পর্যন্ত দফায় দফায় মারধর করেন। একপর্যায়ে তাকে ক্যান্টিনে বসিয়ে ভাতও খাওয়ানো হয়। এরপর পুনরায় মারধর করা হয়। রাত ১০টার দিকে হলের হাউস টিউটররা ঘটনাস্থলে গেলে রাত ১২টার দিকে তাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নিয়ে যান কয়েকজন শিক্ষার্থী। পরে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করলে শিক্ষার্থীরা সেখানে রেখেই চলে আসেন।

কাকচিড়া সাংগঠনিক থানা ছাত্রলীগের সাবেক ১ নম্বর যুগ্ম আহ্বায়ক তকদির হাওলাদার বলেন, ‘তোফাজ্জল পাথরঘাটা উপজেলার কাঁঠালতলী ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন। তবে ৩/৪ বছর ধরে প্রেম সংক্রান্ত একটি ঘটনায় মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েন। পরে মা-বাবা ও ভাইকে হারিয়ে পুরোপুরি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। এখন তার পরিবারে আপন বলতে কেহ নাই। মানসিক ভারসাম্যহীন হয়েও বেঁচে থাকতে পারলো না, তাকে যারা এমন নির্মমভাবে হত্যা করেছে- আমরা তাদের বিচার চাই। এমন ঘটনায় যেন আর কারও জীবন দিতে না হয়।’

এ বিষয়ে তোফাজ্জলের ফুফাতো বোন আসমা আক্তার তানিয়া বলেন, ‘রাত সাড়ে ১১টার দিকে আমার বাবাকে একজন ফোন দিয়ে বলেন, তোফাজ্জল চুরি করতে এসে ধরা পড়েছেন- এখন ৩০ হাজার টাকা পাঠিয়ে দিলে তাকে ছেড়ে দেওয়া হবে। আমার বাবা তার কথা বুঝতে না পেরে আমাকে ওই নম্বরটি দেন। আমি ওই নম্বরে কল দিলে আমার কাছেও একই দাবি করেন। তখন আমি তাদের অনুরোধ করে বলি, তোফাজ্জল মানসিক ভারসাম্যহীন তাকে আপনারা মাইরেন না- তাকে সন্দেহ হলে থানা পুলিশের কাছে দিয়ে দিন। তারা আমার ভাইকে নির্মমভাবে হত্যা করে হাসপাতালে রেখে পালিয়ে গেছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমার ভাইকে যারা হত্যা করেছেন, তাদের বিচারের জন্য আদালতে যতদিন লড়তে হয় আমরা লড়বো। আশা করি, আমরা সঠিক বিচার পাবো।’

পাথরঘাটা উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও পাথরঘাটা উপজেলা চেয়ারম্যান এনামুল হোসেন বলেন, ‘তোফাজ্জল কাঁঠালতলী ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন, পরিবারের সবাইকে হারিয়ে মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে যান। তবে বেশ কয়েক বছর ধরে আমি ওর ভরণপোষণ দিয়ে আসছিলাম। তোফাজ্জলকে চিকিৎসার মাধ্যমে মোটামুটি সুস্থ করেছিলাম, ওকে আমার আপন ভাইয়ের মতো দেখতাম। তবে হঠাৎ আবার অসুস্থ হয়ে গত মঙ্গলবার (১৭ সেপ্টেম্বর) সকালে ঢাকায় চলে যায়। ঢাকায় গিয়ে ঢাকা বিদ্যালয়ের আশেপাশে থাকতো। তার পরিচিত যারা ছিল তাকে খাবার কিনে দিতো। বুধবার (১৮ সেপ্টেম্বর) সন্ধ্যায় তোফাজ্জল ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ের হলে ঢুকে পড়লে রাত ৯টার দিকে একজন আমাকে ফোন দিয়ে বলেন, তোফাজ্জলের সঙ্গে কথা বলেন। তখন তোফাজ্জল হাউমাউ করে কেঁদে উঠে বলে, ভাইয়া আমাকে বাঁচান। তখন আমি ছাত্রদের সঙ্গে কথা বলি। তারা বলেন, তোফাজ্জল ৭টা মোবাইল চুরি করছে, তার জরিমানা পাঠিয়ে দেন।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমি তাদের বলি, তোফাজ্জল মানসিক ভারসাম্যহীন, ওকে আপনারা মাইরেন না। তখন ছাত্ররা ক্ষিপ্ত হয়ে আমাকে গালিগালাজ শুরু করে বলে তুইও ওর সঙ্গে চুরি করছ, পরে আমি ফোন কেটে দেই। এরপর ছাত্ররা তাকে পিটিয়ে হত্যা করে। এমন নির্মম হত্যাকাণ্ড আমরা কীভাবে মেনে নেবো, আমরা দোষীদের বিচার চাই। এভাবে যেন আর কোনও তোফাজ্জলের জীবন দিতে না হয়।’

তোফাজ্জলের নিজ এলাকার প্রতিবেশী আরিফুজ্জামান ইমরান বলেন, ‘আমি রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুহসিন হলের ছোট ভাই সাংবাদিক কবির কাননের ফেসবুক ওয়ালে তোফাজ্জলকে নিয়ে একটি স্ট্যাটাস দেখি, তাকে চোর সন্দেহে মুসলিম হলে আটক করেছে। দেখা মাত্রই কাননকে ফোন করে তোফাজ্জলের বিষয়ে জানাই, ও আমার এলাকার ছেলে, আমি তাকে ব্যক্তিগতভাবে জানি, বর্তমানে ও মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন। হয়তো খাবারের সন্ধানে হলে গেছে। আমি কাননকে বলেছিলাম, তুমি ওখানে যাও- যারা ওরে আটকে রেখেছে তাদের সঙ্গে কথা বলো, তোফাজ্জল মানসিক ভারসাম্যহীন- যাতে তাকে শারীরিকভাবে টর্চার না করে।’

তিনি বলেন, ‘কানন কিছুক্ষণ পরে আমাকে ফোন দিয়ে জানায়, ভাই ওরে আর কেউ টর্চার করবে না- তবে আপনি ওর কোন অভিভাবক পাঠান যার কাছে তাকে দিয়ে দেবে, আমি সেই ব্যবস্থা করতেছি। এরপর আমি আমাদের এলাকার বেশ কয়েকজনের সঙ্গে যোগাযোগ করে হলে পাঠাই তোফাজ্জলকে নিয়ে আসার জন্য- কিন্তু শেষ পর্যন্ত কাউকে ম্যানেজ করতে পারা যায়নি।’

আরিফুজ্জামান বলেন, ‘দুই ঘণ্টার ব্যবধানে ফেসবুকে দেখি, তোফাজ্জল হলের শিক্ষার্থীদের নির্মম নির্যাতনে মারা গেছে।’ এ বিষয়ে আরিফুজ্জামান নিজের ফেসবুক আইডিতে একটি স্ট্যাটাস দিয়ে নিহতের সম্পর্কে বিস্তারিত লেখেন-

আরিফুজ্জামান ইমরানের নিজের ফেসবুক ওয়ালে লেখেন, ‘প্রিয় তোফাজ্জেল আর নেই। এই ছেলেটির নাম তোফাজ্জল। আমার জন্মস্থান বরগুনা জেলার পাথরঘাটা উপজেলার সন্তান। পাথরঘাটা উপজেলার কাঁঠালতলী ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতি। ব্যক্তিগত জীবনে প্রেম সংক্রান্ত একটি বিষয় নিয়ে আঘাতপ্রাপ্ত হওয়ায় প্রথমে কিছুটা মানসিক ভারসাম্য হারায়। এর কিছুদিনের মধ্যে খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে তোফাজ্জলের মা, বাবা ও একমাত্র বড় ভাই মারা যান। গত ৩/৪ বছরে তোফাজ্জল পরিবার ও অবিভাবকশূন্য হয়ে পুরোপুরি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। বিগত ২/৩ বছর তোফাজ্জল প্রায়ই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ঘুরে বেড়াতো। আমাদের এলাকার যারা ওরে চিনতো সবাই সহযোগিতা করতো। ক্যাম্পাসে আমাকে দেখলেই দৌড়ে এসে কুশল বিনিময় করতো। আমি দেখা হলে তাকে খাবার খেতে বলতাম বা খাওয়ার জন্য টাকা দিতাম অথবা ও মাঝেমধ্যে চেয়ে নিত। খাবার ও টাকার বাইরে ওর তেমন চাহিদা ছিল না।’

‘হয়তো আজকেও খাবারের জন্য ওই হলে গিয়েছিল। আহা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ছাত্র নামধারী বিবেকহীন এই নরপিশাচদের জন্য আজকে একটি নিরপরাধ প্রাণ চলে গেলো, আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কলঙ্কিত হলো।’

‘তোফাজ্জল হত্যার বিচার চাওয়ার মতো ওর পরিবারে অবশিষ্ট আর কেউ নেই। তবে দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা হলে আমি ব্যক্তিগতভাবে এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের বিচার নিশ্চিত করতে আইনি প্রক্রিয়ায় লড়ে যাবো।’

এ বিষয়ে শাহবাগ থানার ওসি খালিদ মুনসুর বলেন, ‘রাতে ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের মাধ্যমে জানতে পারি, তোফাজ্জল নামের একজনকে ঢাকা মেডিক্যালে হাসপাতালের জরুরি বিভাগে আহত অবস্থায় নিয়ে আসা হয়েছে। পরে হাসপাতালের জরুরি বিভাগের কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। লাশ ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিক্যাল হাসপাতালের মর্গে রাখা হয়েছে। তবে আইনি প্রক্রিয়া শেষে স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘এ বিষয়ে যদি কেউ লিখিত অভিযোগ দেন তাহলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

- Advertisement -spot_img
spot_img

সর্বশেষ খবর

spot_img
আরও খবর
spot_img

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here