আলী হোসাইন: যশোরের চৌগাছা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের যাত্রা শুরু হয় ১৯৮৩ সালের ৩০ জুন। রোগীদের সাশ্রয়ী ও মানসম্মত চিকিৎসা নিশ্চিতের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি। দেশে স্বাস্থ্যসেবায় এটি একটি মডেল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। বর্তমানে উপজেলার ১১টি ইউনিয়নের দুই লাখ ৬৯ হাজার মানুষের সেবা দিয়ে আসছে প্রতিষ্ঠানটি। আশপাশের উপজেলা থেকেও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ চিকিৎসা নেন এখান থেকে। স্বাস্থ্য কেন্দ্রটি উপজেলায় পরিচিতি পেয়েছে সু-চিকিৎসার আশ্রয়স্থল হিসেবে।
প্রতি মাসে গড়ে প্রায় ১৫০+ স্বাভাবিক ডেলিভারি হয় এই হাসপাতালে।
সাধারণ স্বাস্থ্য সেবার পাশাপাশি প্রসূতি মায়েদের স্বাস্থ্য সেবায় বরাবরই প্রথম এ হাসপাতাল। ২০১৭, ২০১৮ ও ২০২০ সালে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাতীয় পুরস্কার অর্জন করেছে চৌগাছা উপজেলা মডেল স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স।
স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটিতে নিয়মিত জরায়ু মুখ ও স্তন ক্যান্সার পরীক্ষা করা হয়। প্রতিদিন অফিস সময়ে একজন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নার্স দ্বারা ৩০ থেকে ৬০ বছর বয়সী মহিলাদের বিনামূল্যে এই পরীক্ষা করা হয়। গত জুন ও জুলাই মাসে মোট ৪৭৭ জন মহিলার পরীক্ষা করা হয়। এ সময় জরায়ু মুখ ও স্তন ক্যান্সার শনাক্ত হয়েছে ১৮ জনের। জুনে ৮ ও জুলাই মাসে ১১ জন। জুন-জুলাই মাসে ১৮৫টি স্বাভাবিক ডেলিভারি হয়েছে এই হাসপাতালে।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক আছেন চার জন। তাদের মাধ্যমে রেফারকৃত রোগীদের চিকিৎসা সেবা দেওয়া হয়। দন্ত রোগীদের চিকিৎসা সেবা প্রদানের জন্য এখানে একজন ডেন্টাল সার্জন রয়েছে। বহির্বিভাগে প্রতি মাসে প্রায় ১৬ হাজার রোগী চিকিৎসা সেবা নেন এ হাসপাতাল থেকে। চলতি বছরের শুরু থেকে এ পর্যন্ত এ বিভাগে সেবা নিয়েছেন প্রায় ১ লাখ মানুষ।
প্রতিদিন গড়ে ৫০ থেকে ৬০ জন রোগী ভর্তি থাকেন। রোগীরা তাৎক্ষণিকভাবে ফোনে চিকিৎসকদের সঙ্গে সাথে যোগাযোগ করতে সেলফোন বেইজড হেলথ সার্ভিসের ব্যবস্থা রয়েছে। রোগীর স্বজনদের খাবারের জন্য ডাইনিংয়ের ব্যবস্থা রয়েছে। ফলে ওয়ার্ডগুলো পরিষ্কার থাকে। এ ছাড়া হাসপাতালে নিরাপদ পানির ব্যবস্থা আছে।
হাসপাতালে আগত শিশুদের খেলাধুলার জন্য স্থাপন করা হয়েছে কিডস কর্নার। চিকিৎসা নিতে আসা গর্ভবতী মায়েদের জন্য রয়েছে বিশ্রাম কক্ষ।
২৪ ঘণ্টাই প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মিডওয়াইফ ও নার্স দ্বারা বিনামূল্যে স্বাভাবিক ডেলিভারির মাধ্যমে নিরাপদে বাচ্চা প্রসব করানো হয় এ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। গর্ভবতী মায়েদের নিয়মিত চেক আপ ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয় যত্ন সহকারে। এ ছাড়া মোবাইল ফোনের মাধ্যমে গর্ভবতী ও প্রসূতি মায়েদের খোঁজ-খবর নেওয়া হয়। গত জুন ও জুলাই মাসে ১৮৫টি স্বাভাবিক ডেলিভারি হয়েছে এই হাসপাতালে। এ সময় সিজিরিয়ান সেকশন হয়েছে ১৬০টি। প্রসূতি মাতৃসেবায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি।
৫০ শয্যার হাসপাতালটিতে চিকিৎসকের পদ রয়েছেন ৩২টি। তবে কর্মরত আছেন ১৮ জন চিকিৎসক। মেডিসিন, নাক-কান ও গলা বিশেষজ্ঞসহ গুরুত্বপূর্ণ ১৪টি পদ খালি রয়েছে। পর্যাপ্ত সংখ্যক নার্স ও মিডওয়াইফ থাকলেও টেকনোলোজিস্ট রয়েছে নির্ধারিত সংখ্যার অর্ধেক। জনবল সংকটের কারণে কর্মরত চিকিৎসকদের নিতে হচ্ছে বাড়তি চাপ। এরপরও হাসিমুখে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন চিকিৎসকরা। সেবা প্রদানকারীরা কর্মস্থলে উপস্থিত হন সকাল ৮টার মধ্যে।
হাসপাতালে রয়েছে একটি এনসিডি কর্নার, যেখানে ওয়ান স্টপ সার্ভিস দেওয়া হয়। অর্থাৎ ডায়েবেটিক ও উচ্চ রক্তচাপজনিত রোগে যারা ভুগেন, তাদের একই সাথে নিয়মিত চেকআপ ও ফ্রি ওষুধ দেওয়া হয়। এখানে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য রয়েছে আলাদা কর্নার। এ ছাড়া রোগীদের সুবিধার্থে রেফারেল কর্নার স্থাপন করা হয়েছে।
যক্ষ্মা রোগের চিকিৎসায় সর্বাধুনিক জিন এক্সপার্ট মেশিন দ্বারা কফ পরীক্ষাসহ যাবতীয় চিকিৎসা সেবা বিনামূল্যে প্রদান করা হচ্ছে এই হাসপাতালে। সবচেয়ে বেশি করা হয় আল্ট্রাসনোগ্রাম পরীক্ষা। প্রয়োজনীয় বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যবস্থায় থাকায় রোগীদের পরীক্ষা করতে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের বাহিরে যেতে হয় না। ফলে ভোগান্তি ও দালালদের খপ্পরে পড়তে হয় না।
৮০ টাকায় ইসিজি, ১১০ টাকা ও ২২০ টাকায় দুই ধরনের আল্ট্রাসনোগ্রাম ও ৭০ টাকায় এক্স-রে করা হয়। এ ছাড়া স্বল্পমূল্যে রক্ত, প্রস্রাব, ডায়াবেটিস, ডেঙ্গু ও কোভিড-১৯ পরীক্ষাসহ অন্যান্য বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়।
এখানে সরকারি খরচে সিজারিয়ান সেকশন, ফোড়া নিষ্কাশন (এ্যাবসেস ড্রেনেজ) ও ডায়লেশন অ্যান্ড কিউরাটেজ (ডি অ্যান্ড সি) অপারেশন করা হয়।
চৌগাছা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সাপে কাটা, কুকুর ও বিড়ালে রোগীর চিকিৎসা নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। এসব রোগীদের জন্য রয়েছে ভ্যাকসিনের সুব্যবস্থা।
উপজেলায় ২৭টি কমিউনিটি ক্লিনিকে কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডারদের (সিএইচসিপি) মাধ্যমে বিভিন্ন সাধারণ রোগের জন্য বিনামূল্যে ওষুধ দেওয়া হয় ও অন্যান্য সেবা দেওয়া হয়।
শিডিউল অনুসারে স্বাস্থ্য সহকারীদের মাধ্যমে শিশুদের এবং ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সী নারীদের ১০টি রোগের জন্য প্রতিষেধক হিসেবে ৭টি টিকা প্রদান করা হয়। বছরে দুইবার ছয় মাস থেকে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের ভিটামিন এ ক্যাপসুল খাওয়ানো হয়। বছরে দুই বার পাঁচ থেকে ১৬ বছর বয়সী শিশুদের স্কুলে খুদে ডাক্তার কার্যক্রমের মাধ্যমে স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও কৃমিনাশক ওষুধ খাওয়ানো হয়।
হাসপাতালের ২টি অ্যাম্বুলেন্স রয়েছে। সরকার নির্ধারিত নির্দিষ্ট ভাড়ার (প্রতি কিলোমিটার ১০ টাকা) বিনিময়ে রেফারকৃত রোগীদের ২৪ ঘণ্টাই অ্যাম্বুলেন্স সেবা দেওয়া হয়।
চৌগাছা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা (ইউএইচএফপিও) হিসেবে বর্তমানে দায়িত্ব পালন করছেন ডা. মোছা. লুৎফুন্নাহার। যার হাতের ছোঁয়ায় রোগী বান্ধব হয়েছে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি। মেডিভয়েসের সঙ্গে আলাপকালে হাসপাতালের সংকট ও সম্ভাবনার কথা তুলে ধরেন তিনি।
ডা. লুৎফুন্নাহার বলেন, ‘মডেল উপজেলা ধরে রাখা আসলেই চ্যালেঞ্জিং। আমাকে এমন দায়িত্ব প্রদান করার জন্য সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞ আমি। কমিউনিটি পার্টিসিপেশনের মাধ্যমে এ এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ যথেষ্ট সহযোগিতা করেন, যে কারণে কাজের পরিবেশ অনুকূল করেছে।’
প্রয়োজনের তুলনায় জনবলের স্বল্পতা আছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘জনবল স্বল্পতার (বিশেষ করে ৪র্থ শ্রেণির) জন্য আমাকে হিমশিম খেতে হয়। সব কিছু সামলে এ উপজেলার বাসিন্দাদের সর্বোচ্চ চিকিৎসা সেবা দেওয়ার চেষ্টা করছি।’
হাসপাতালে সেবার মান ও পরিধি বৃদ্ধি পাচ্ছে জানিয়ে ইউএইচএফপিও আরও বলেন, ‘বিভিন্ন কর্নার করার মাধ্যমে বিশেষ সেবা দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে স্বাস্থ্য শিক্ষার দিকে। সর্বোপরি রোগী হাসপাতালমুখী হচ্ছে, এটি একটি বড় সার্থকতা।’
২০১০ সালে কর্মজীবনের শুরুতেই যশোর সদরের ইছালী ইউনিয়ন উপ-স্বাস্থ্যকেন্দ্রে মেডিকেল অফিসার হিসেবে নিয়োগ পান ডা. লুৎফুন্নাহার। তারপর ডেপুটেশনে যশোর ২৫০ শয্যা হাসপাতালে দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৯ সালের ১৯ মে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা হিসেবে খুলনার তেরোখাদা ও ২০১৯ সালের ২১ ডিসেম্বর চৌগাছা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।