তার লেখা বাঙালি জাতির হৃদয়ে চির বহমান হয়ে রবে।
বাংলা সাহিত্যের নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ। তিনি যতদিন বেঁচে ছিলেন দু’হাত ভরে লিখেছেন। তার সাবলীল বাক্যে অজস্র গল্প নদীর মতো বয়ে চলেছে বাঙালির চির মননে। যেখানে, মাঝরাতে হিমুর রাস্তায় ঘোরাঘুরি, ছাদে দাঁড়িয়ে রূপার অপেক্ষা, তীক্ষè দৃষ্টিতে তাকানো মিসির আলি, শুভ্র কিংবা বাকের ভাই। বাঙালির হৃদয় থেকে কোনো দিনই মুছে যাবে না এসব চরিত্রের আবেদন। সত্যি বলতে বাঙালি পাঠককে এতটা পরিব্যাপ্ত করে আর কেউ ছুঁতে পারেননি আগে। তার সময়ে আরও অনেকেই লিখেছেন। কিন্তু, তাদের সঙ্গে হুমায়ূন আহমেদের মূল পার্থক্য ছিল লেখার ভঙ্গিতে। তার লেখাতে একধরনের মোহ ও জাদু ছিল। তাই তিনি হয়ে উঠেছিলেন বাংলা সাহিত্যের জাদুকর। তার কলমের রসবোধের সঙ্গে লৌকিকতা আর অলৌকিকতার সমগ্র সুন্দরের মিছিলে বাংলা কথাসাহিত্যকে করেছেন সমৃদ্ধ। আজ সেই কিংবদন্তি কথা সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের ৭৫তম জন্মদিন।
১৯৪৮ সালের ১৩ নভেম্বর নেত্রকোনা জেলার মোহনগঞ্জে নানাবাড়িতে হুমায়ূন আহমেদ জন্মগ্রহণ করেন। পিতার বাড়ি নেত্রকোনাতেই কেন্দুয়া উপজেলার কুতুবপুর গ্রামে। পিতা ফয়জুর রহমান ও মাতা আয়েশা ফয়েজ দম্পতির প্রথম সন্তান তিনি। তার বাবা একজন পুলিশ কর্মকর্তা ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পিরোজপুর মহকুমার এসডিপিও হিসেবেও কর্মরত ছিলেন তিনি। কর্তব্যরত অবস্থায় তিনি ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন পাকবাহিনীর হাতে শহীদ হন।
হুমায়ূন আহমেদের পরিবার ছিল সাহিত্যমনা। তাই তার ভিতটাও পরিবার থেকে গড়ে উঠেছিল। তিনি ১৯৬৫ সালে বগুড়া জিলা স্কুল থেকে মেট্রিক পরীক্ষায় সম্মিলিত মেধা তালিকায় দ্বিতীয় স্থান লাভ করেন। এরপর ১৯৬৭ সালে ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন। পরে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগে।
১৯৭২ সালে রসায়ন বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর শেষ করেন এবং একই বিভাগের প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৮২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ডাকোটা স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে পলিমার কেমিস্ট্রিতে পিএইচডি করেন। তবে, লেখালেখি যার স্বপ্ন, আরাধনা তার তো শিক্ষকতা মানায় না। তাই অধ্যাপনা ছেড়ে দিলেন হুমায়ূন আহমেদ। মনোযোগী হলেন নিজের লেখালেখি ও চলচ্চিত্র নির্মাণে।
চলচ্চিত্র নির্মাণে দারুণ সফল ছিলেন এই কিংবদন্তি। তার নির্মিত প্রথম চলচ্চিত্র ‘আগুনের পরশমনি’। এটি ছিল মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক। এ ছাড়া তার অন্যান্য উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র হলো- শঙ্খনীল কারাগার, শ্যামল ছায়া, শ্রাবণ মেঘের দিন, দুই দুয়ারী, চন্দ্রকথা, নয় নম্বর বিপদ সংকেত, নন্দিত নরকে, প্রিয়তমেষু, দারুচিনি দ্বীপ, আমার আছে জল, ঘেটুপুত্র কমলা ইত্যাদি।
নাট্যকার হিসেবেও তিনি পেয়েছিলেন আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তা। এই সব দিনরাত্রি, বহুব্রীহি, কোথাও কেউ নেই, নক্ষত্রের রাত, অয়োময়, আজ রবিবার, সবুজ সাথী, উড়ে যায় বকপক্ষী, এই মেঘ এই রৌদ্র, কালা কইতর, চন্দ্র কারিগর ইত্যাদি নাটক দর্শকমহলে খুবই সাড়া ফেলেছিল।
১৯৭২ সালে হুমায়ূন আহমেদের প্রথম উপন্যাস ‘নন্দিত নরকে’ প্রকাশিত হয়। প্রথম বই দিয়েই আলোচনায় আসেন তিনি। সেই যে শুরু, তা চলেছিল মৃত্যুর আগ পর্যন্ত। এই সময়ে তিনি দুই শতাধিক উপন্যাস লিখেছিলেন। হুমায়ূন আহমেদের সৃষ্ট চরিত্রগুলোর মধ্যে আছে- মিসির আলী, হিমু, শুভ্র ইত্যাদি।
হুমায়ূন আহমেদ তার দীর্ঘ চার দশকের সাহিত্যজীবনে ভূষিত হয়েছেন বিভিন্ন পুরস্কারে। এর মধ্যে একুশে পদক, বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, হুমায়ুন কাদির স্মৃতি পুরস্কার, লেখকশিবির পুরস্কার, মাইকেল মধুসূদন দত্ত পুরস্কার, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ও বাচসাস পুরস্কার অন্যতম। এ ছাড়া বিভিন্ন সময় দেশের বাইরেও সম্মানিত হয়েছেন তিনি।
২০১২ সালের ১৯ জুলাই নিউইয়র্কের বেলভিউ হাসপাতালে ক্যানসারে আক্রান্ত চিকিৎসাধীন হুমায়ূন আহমেদ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। নন্দিত এই কথাসাহিত্যিককে তারই প্রিয় গাজীপুরের নুহাশপল্লীর লিচুতলায় চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয়।
জানা গেছে, নানা কর্মসূচির মাধ্যমে গাজীপুর সদর উপজেলার পিরুজালীতে অবস্থিত হুমায়ূন আহমেদের হাতে গড়া স্বপ্নের নুহাশপল্লীতে তার জন্মদিন উদযাপন করা হবে। জন্মদিন উপলক্ষে নুহাশপল্লীর উদ্যোগে কেক কাটা ও রাতে সহস্রাধিক মোমবাতি প্রজ্বালন করা হবে। হুমায়ূন আহমেদের স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওন, ছেলে নিষাদ ও নিনিতও নুহাশপল্লীতে বিশেষভাবে স্মরণ করবেন হুমায়ূনকে। সকাল ১০টায় তারা হুমায়ূন আহমেদের কবরে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন। কবরের পাশে দোয়া ও ফাতেহা পাঠ করা হবে। অন্যদিকে, হুমায়ূন আহমেদের জন্মদিন উপলক্ষে চ্যানেল আইয়ে আজ ১৩ নভেম্বর সকাল সাড়ে ৭টায় প্রচার হবে সেরাকণ্ঠ ও খুদে গানরাজদের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠান ‘গান দিয়ে শুরু’। বিকাল ৩টা চ্যানেল আই চেতনা চত্বর থেকে সরাসরি সম্প্রচার করা হবে ইউনিভার্সেল মেডিক্যাল কলেজ হসপিটাল চ্যানেল আই হুমায়ূন মেলা, পাওয়ার্ড বাই-নতুনধরা। বিকাল ৫টায় দেখানো হবে ব্লকবাস্টার সিনেমা হুমায়ূন আহমেদ নির্মিত ইমপ্রেস টেলিফিল্ম-এর ছবি ‘নয় নম্বর বিপদ সংকেত’।